নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাহিন রেজওয়ান। তিনি চার তলা যে বাড়িতে বসবাস করে সেখানকার এক প্রতিবেশীর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনা ধরা পড়ে। এই রোগীর সঙ্গে তার পরিবারের সংস্পর্শের ইতিহাস ছিল। রেজওয়ানের নিজের দেহে করোনা আক্রান্ত হবার বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিলে গত ৮ জুন বিভাগের একমাত্র করোনা রোগ নির্ণয় কেন্দ্র শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য যান। কিন্তু পরপর তিনদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে সেখানে গিয়েও করোনা পরীক্ষা করাতে পারেন নি তিনি। এর ওপর সেখানকার নানা অনিয়মের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে তাকে।
গত ২৯ মার্চ থেকে বরিশাল বিভাগের একমাত্র করোনা পরীক্ষা (রোগ নির্ণয়) কেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে এখানকার শেবাচিম আরটি-পিসিআর গবেষণাগার। ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে মাত্র একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের কার্যক্রম নিয়ে এখন দানা বাধতে শুরু করেছে নানা অভিযোগ।
এছাড়া বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্যও নেই পর্যাপ্ত জনবল। শেবাচিমে করোনা পরীক্ষা করতে যাওয়া, চিকিৎসা নেওয়া কিংবা বরিশালের সচেতন নাগরিক হিসেবে পরিচিত অনেকে এখানকার করোনা পরীক্ষার নানা বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে উগরে দিয়েছেন ক্ষোভ। তবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নানান অভাব ও বাধা উপেক্ষা করেও তারা জনগণের সেবাকেই প্রধান্য দিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রে বর্তমানে অনভিজ্ঞ টেকনোলজিস্ট দ্বারা সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হচ্ছে। যে কারণে পরীক্ষার ফলাফলের নির্ভুলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া গত বেশ কদিনের করোনা পরীক্ষার তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার এই বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ টির বেশি পরীক্ষা করানো হচ্ছে না। আর এই স্বল্প সংখ্যক পরীক্ষার সুযোগও সাধারণ মানুষদের জন্য সোনার হরিণ। প্রতিদিন সকাল থেকে করোনা পরীক্ষার জন্য শেবাচিম এ মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকলেও সুযোগ পাচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকজন। বেশিরভাগ পরীক্ষাই করা হয় এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সুপারিশ প্রাপ্ত ব্যক্তিদের।
শেবাচিম করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত একজন টেকনোলজিস্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ৪ তারিখ থেকে তিনি সহ আরো চারজনকে সেখানে মাত্র তিনদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করা হয়। বর্তমানে তারাই সেখানে করোনা পরীক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। এর আগে বিভূতি ভূষণ নামে মাত্র একজন স্থায়ী টেকনোলজিস্ট দিয়ে সেখানে করোনা পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করানো হতো। তিনি একা প্রায় আড়াই মাস কাজ করেছেন। তিনি বলেন, প্রশিক্ষিত স্থায়ী টেকনোলজিস্ট সংকট শেবাচিম এর করোনা পরীক্ষাকে সংকটে ফেলেছে। আমরা চাই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট নিয়োগ করা হোক। অন্যদিকে দীর্ঘ চেষ্টার পরও করোনা পরীক্ষা না করতে পারা নাহিন রেজওয়ান জানান, বাড়িতে করোনা রোগী চিহ্নিত হবার পর আমরাও দুঃশ্চিন্তায় পড়ি।
এর মধ্যে আমার জ্বর , বুকে ব্যথা সহ বিভিন্ন করোনা উপসর্গ দেখা দিলে শেবাচিমে যাই। কিন্তু তিনদিন সেখানে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষের ঢলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও করোনা পরীক্ষা করাতে পারি নি। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন প্রতিদিন ২০টির বেশি নমুনা সংগ্রহ করা হয় না। কিন্তু আমার সামনেই অনেকে চিকিৎসককে মুঠোফোনে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়ে করোনা পরীক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। এমনকি তাদের লাইনেও দাঁড়াতে হয় নি।
তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে আমার পরিবারের বৃদ্ধ বাবা-মা সহ অন্য সদস্যরাও জ্বরে ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। কিন্তু আমরা এতটাই অসুস্থ ছিলাম যে শেবাচিম এ যাওয়া সম্ভব হয় নি। আল্লাহকে শেষ ভরসা মনে করেই এখনো বাসাতেই নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা দিচ্ছি। নাহিন রেজওয়ান এর মতো এমন একই অভিযোগ পাওয়া গেছে সেখানে করোনা পরীক্ষা করতে যাওয়া ও চিকিৎসা নেওয়া একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে। কয়েকজন জানিয়েছেন তাদের পরীক্ষার ফলাফলের বিভিন্ন তথ্যে ভুল এসেছে। যে কারণে আদৌ তারা করোনা আক্রান্ত নাকি আক্রান্ত নন এই প্রশ্নও সামনে এসেছে। আর এমন সন্দেহ আরো গাঢ় হয়েছে যখন তারা জানতে পেরেছেন এই পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত অনভিজ্ঞ অস্থায়ী টেকনোলজিস্টরা।
বিভাগের করোনা পরীক্ষার এমন চিত্র ভয়াবহ পরিস্থিতি টেনে আনবে বলে দাবি করছেন বাংলাদেশ প্রগতিশীল চিকিৎসক ফোরামের সংগঠক ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী। তিনি জানান , গত এক সপ্তাহে বরিশালে যে ২০০ জনের মতো করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই এখানকার কোন সরকারি কর্মকর্তা – কর্মচারী কিংবা ক্ষমতাশালী কারো আত্মীয়- স্বজন বলে আমরা চিহ্নিত করেছি। এই তথ্য পরিপূর্ণ ভাবে নির্দেশ করে যে সাধারণ মানুষ করোনার সরকারি স্বাস্থ্য সেবার ন্যূনতম উপকার ভোগ করতে পারছেন না। তিনি বলেন, এখানে টেকনোলজিস্টের অভাবে করোনা পরীক্ষার বেহাল দশার কথা সবার জানা। তবুও এতদিনে এখানকার সরকারি প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন নি যা আমাদের জন্য হতাশার। তিনি উল্লেখ করেন, দ্রুত বিভাগের প্রতিটি জেলায় করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন ও মানুষের হাঁটা দূরত্বে করোনা পরীক্ষার নমুনা জমা দেবার বুথ তৈরি করা এই অঞ্চলের মানুষের বাঁচার দাবিতে পরিণত হয়েছে। বরিশালের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গঠিত সরকারি কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এখানকার সিভিল সার্জন ডাঃ মনোয়ার হোসেন। তিনি টেকনোলজিস্ট সংকটের কথা স্বীকার করলেও অনভিজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে না বলে দাবি করেন।
তিনি জানান, আমাদের সক্ষমতার তুলনায় দ্বিগুণ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। স্বল্প জনবল নিয়ে করোনা পরীক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি পুরো জেলায় মাত্র ৭ জন টেকনোলজিস্ট নিয়ে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। এছাড়া ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে বরিশালে আরো তিনটি করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন ও টেকনোলজিস্ট সংকট নিরসনের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আর নতুন পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন না করলে নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপন করে কোন লাভ নেই বলেও জানান তিনি। তবে তিনি উল্লেখ করেন , অনেকে শুধুমাত্র মানসিক সন্তুষ্টির লাভে বা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা প্রদান করতে চান। কিন্তু করোনার পরিচিত উপসর্গ দেখা না দিলে পরীক্ষা করা উচিত নয়। এতে করে যে মানুষটার সত্যিকারে পরীক্ষা দরকার সে হয়তো বঞ্চিত হচ্ছে।
Leave a Reply